আমুদরিয়া নিউজ : ক্যান্সার, শব্দটা শুনলেই মনে একটা আতঙ্ক কাজ করে। যতই টাকা খরচ করনা কেনো, এর থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ রোগের তালিকাতেই পরে এই ক্যান্সার। আমরা এটাই মনে করি যে ক্যান্সার হলে তার ফল একমাত্র মৃত্যু। এর থেকে হাতে গোনা কয়েকজনই সুস্থ হয়েছেন। জীবনের লড়াইতে হেরে যাওয়াই হল ক্যান্সার।
কিন্তু আসলে তা নয়, ক্যান্সার মানেই মৃত্যু নয়। ক্যান্সার মানেই হার নয়। কান্সার মানে অভিজ্ঞতা, জীবনের এক বিরাট লড়াই হল কান্সার। এর প্রমাণ দিলেন মধ্যপ্রদেশের এক ব্যক্তি।
মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দা, ৩২ বছরের হার্তেইজ ভরতেশ, ২৩ বছর বয়স থেকেই ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে চলেছেন। তিনি পেশায় একজন আইনজীবী।
২০১২ সালে কলেজের শেষ সেমিস্টারে পড়া কালীন তিনি ঘাড়ে ফোলা ভাব অনুভব করতেন। প্রথমে তিনি এটাকে সাধারণ ব্যথা ভেবে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেছিলেন। কিন্তু, তা না কমায়, ২০১৩ সালে, তিনি তার ভাইয়ের সাথে বেঙ্গালুরুতে দেখা করতে যান। সেখানেই বায়োপসি করানোর পর তার তৃতীয় স্টেজ হজকিনস লিম্ফোমা ধরা পড়ে। যা একটি বিরল ধরনের রক্তের ক্যান্সার। এটা জেনেও তারা ভেঙে না পড়ে, এই রোগের সাথে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন। হার্তেইজের পরিবার কিছুটা হলেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। কিন্তু তিনি ঠিক করেছিলেন তাকে যেভাবেই হোক সুস্থ হতে হবে।
তাকে ডাক্তার জানিয়েছিল কলেজ ও হস্টেলের বাসি তেলে বানানো খাবারই এর জন্য দায়ী, এই বিষয়ে তিনিও নিশ্চিত ছিলেন। পড়াশোনা শেষ না করা অবধি তিনি কেমোথেরাপি শুরু করেননি। তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাই করিয়েছিলেন। যার ফলে তার অবস্থার আরও অবনতি ঘটে।
২০১৪ সালে যখন তিনি এমবিএ পড়তে বেঙ্গালুরুতে যান। জানা যায়, তার কান্সার চতুর্থ পর্যায়ে রয়েছে এবং হাড়েও ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি চিকিৎসার জন্য তার ভাইয়ের সাথে হায়দরাবাদে চলে যান। এই অবস্থায় তিনি একটু চিন্তিত হয়ে পড়েন। তার চিন্তার আসল কারণ ছিল কিভাবে তার পরিবার এই চিকিৎসার খরচ চালাবে এবং চিকিৎসার পরে আদেও তিনি বাঁচবেন কি না।
প্রথম ১২ টা কেমোথেরাপির পর তিনি ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েন। তিনি তার চুল, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সহ সব শক্তিই হারিয়ে ফেলেন। এই কঠিন সময়ে তার একমাত্র ভরসা ছিল তার ভাই শ্রোথ ভরতেশ। তিনি সবসময় হার্তেইজ কে মানসিক জোর বাডিয়ে দিতেন।
হার্তেইজের এতটা অবনতির কথা তার ভাই ছাড়া পরিবারের আর কেউ তেমন জানতেন না। তার মা যখন তাকে দেখতে এসেছিলেন তখন মায়ের আদরে ও তার হাতের রান্নায় হার্তেইজের সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। এ কথা তিনিই পরে জানিয়েছেন।
দীর্ঘ চিকিৎসার পর, কিছুটা সুস্থ হয়ে, ২০১৫ সালে তিনি রায়পুরে চলে যান। রোগ থেকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে, যোগ ব্যায়াম ও জিমে যাওয়া শুরু করেন।
২০১৬ সালে তিনি পুনেতে চাকরির খোঁজে যান। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন কারণে তার কোন চাকরি হয় না। ক্যান্সারের কাহিনী বলার পরেও, নানা জায়গায় প্রত্যাখ্যান পান তিনি। তবে এই প্রত্যখ্যানই তাকে জীবনে নতুন পদক্ষেপ নেওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়।
রাইড অফ হোপের জন্ম, তিনি সিদ্ধান্ত নেন ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াবেন। তখনই ক্যান্সার সচেতনতার যাত্রার কথা তার মাথায় আসে। তিনি ঠিক করে সারা দেশ ঘুরে ক্যান্সার রোগীদের সাথে দেখা করে তিনি তাদের অনুপ্রেরণা দেবেন যে কেমোথেরাপির পরেও জীবন ভাল ভাবেই চলতে পারে। কিন্তু তার এই স্বপ্ন পূরণে অনেক টাকার প্রয়োজন ছিল। তিনি তার বাবার থেকে কিছু টাকা নিয়ে ও তার সহ বাইক রাইডার্সরা মিলে ৩০,০০০ টাকা জোগাড় করে, তাদের এই যাত্রা শুরু করেন।
২০১৬ সালের, ১ মে তারা একটি দীর্ঘদিনের যাত্রায় বেরিয়ে পড়েন যেখানে তারা ১৫ টি রাজ্য ও ২২ টি শহরের ক্যান্সার রোগীদের সাথে দেখা করেন। হার্তেইজ তাদের সাথে নিজের কাহিনী শেয়ার করেন এবং রোগীদের ক্যান্সারের লড়াইতে উৎসাহ দেন।
এই উদ্যোগে অনেক রোগী সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের সাথে যোগাযোগ করেন। বিভিন্ন জায়গায় হাসপাতালে ভর্তি ক্যান্সার রোগীদের সাথে তিনি কথা বলতেন। তিনি আবেগের সাথে জানান, এই যাত্রায় অনেকেই তাকে কোন মূল্য ছাড়াই থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
হার্তেইজ জানান, পুনেতে তার এক আরোহীর সাথে দেখা হয়েছিল। অদ্ভুত ভাবে তারও ঘাড়ে একই জায়গায় ফুলে গিয়েছিল যেখানে হার্তেইজ এর ফোলাভাব ছিল। তিনি তৎক্ষণাৎ তাকে চিকিৎসার কথা বলেন। সেই ব্যক্তিরও একই জায়গায় ক্যান্সার ধরা পড়ে। কিন্তু তাড়াতাড়ি চিকিৎসা করে তিনি অনেকটাই সুস্থ হয়ে যান। তার পরিবার এই জন্য হার্তেইজ কেই কৃতিত্ব দেন।
তার অনুপ্রেরণা, স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন মহিলা ক্যান্সারের সাথে লড়াই করার শক্তি খুঁজে পেয়েছেন, যিনি এখন সুস্থ রয়েছেন।
আজ, হার্তেইজ, তার এনজিও, হার্তেইজ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মানুষকে ক্যান্সার লড়াইতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে রোগীদের চিকিৎসা না দিতে পারলেও, মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সহায়তা করছেন তিনি।
কিছু দিন পরেই বিয়ে করে তার জীবনের আরেকটি নতুন ধাপ শুরু করতে চলেছেন হার্তেইজ। তার হবু স্ত্রীও একজন কান্সার সারভাইভার এবং পেশায় একজন ডাক্তার। হার্তেইজ আশা রাখেন বিয়ের পর তিনি ও তার স্ত্রী মিলিতভাবে ক্যান্সার জয়ের এই যাত্রাকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তাদের এই আশার যাত্রা শুধু মাত্র ক্যান্সার রোগীদের সাথে দেখা করার যাত্রাই নয়, বরং জীবনের এক লড়াইয়ের কাহিনী, যা সকলকে অনুপ্রাণিত করবে, এমনই মনে করেন হার্তেইজ।
প্রতিবেদক : শিউলি ভট্টাচার্য্য