আমুদরিয়া নিউজ : সকলের জীবনেই ছোট বড় অসুবিধা আসে, যখন আমরা মনে করি জীবনে আর কিছু করার নেই , অনেকে আত্মহত্যার মত কঠিন সিদ্ধান্তও নেন। কিন্তু, এক পরিবারের নানা বাধার মাঝেও লড়াই করে ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনী শুনলে নিজের খারাপ সময়গুলোর কথা ভুলে ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছে হবে। জীবনে লড়াই করা শিখিয়েছে এই পরিবার।
আজকের কাহিনীটি উত্তরপ্রদেশের মিরাটের ৫৬ বছরের লাভিনা জৈন ও তার স্বামীর। তাদের একটি বড় পরিবহণের ব্যবসা ছিল। কিন্তু ২০১০ সালে সব ওলটপালট হয়ে যায়। লাভিনার স্তনে ও তার স্বামীর মুখে ক্যান্সার ধরা পড়ে। দুজনেরই একসাথে চিকিৎসা চলছিল। করা হয় অপারেশন, তারপর কেমোথেরাপি, রেডিও থেরাপি প্রভৃতির খরচে তাদের ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যায়। তারা আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের কাছে টাকা ধারের কথা বললেও নিশ্চিত ছিল না কিভাবে তারা সেটা শোধ করবে। তাদের দুই সন্তান, এক ছেলে ও এক মেয়ের পড়াশোনা, প্রতিদিনের খাওয়াদাওয়ার খরচ, এসব ভাবতে ভাবতে তারা বাড়ি বিক্রির মত কঠিন সিদ্ধান্তও নেন।
লাভিনা, সংবাদদাতাদের জানিয়েছেন, বাড়ি বিক্রি তাদের লড়াইতে হেরে যাওয়ার মত হলেও, তাদের লড়াই থামেনি। তারা শুধুমাত্র শারীরিক ভাবেই নয়, মানসিক ভাবেও ভীষণ ভেঙে পড়েন। কিন্তু তবুও তারা তাদের লড়াই চালিয়ে গেছেন। আর এই লড়াইতে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে লাভিনা দেবীর রান্নার গুণ।
২০১১ সালে রান্নার প্রতি নিজের আবেগকে তিনি ব্যবসার রূপ দেন। গড়ে তোলেন ‘লাভিনার তৃপ্তি ফুডস’। যেখানে তিনি ঘরে তৈরি আচার, জ্যাম, স্কোয়াশ ইত্যাদি আরও সুস্বাদু খাবার বানিয়ে বিক্রি করেন।
বয়ামে ভরা এই খাবার গুলিই হয়ে উঠে তাদের ক্যান্সার ও জীবনের লড়াইয়ের প্রতীক।
কিভাবে এই ব্যবসার কথা তার মাথায় আসে?
এই প্রশ্ন করতেই লাভিনা জানান, প্রায় আট মাস ধরে ক্যান্সারের চিকিৎসা চলার পর তারা সংসার কিভাবে চালাবেন এই চিন্তায় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। ঠিক সেই সময় লাভিনার মাথায় আসে, ১৯৮০ সালে তিনি স্কুলে আচার, সস, জ্যাম ইত্যাদি বানিয়ে রাখার কোর্স শিখেছিলেন। আর তখনই তার স্বামীর উৎসাহে তিনি এটাকেই ব্যবসায় রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার স্বামী প্রায় ছয় মাস কথা বলতে পারেননি এবং শারীরিক ভাবে দুর্বল হলেও তার স্ত্রীকে পূর্ণ উৎসাহ দিয়েছেন।
কিভাবে তিনি এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন?
জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেন, প্রথম ধাপে তিনি উত্তরপ্রদেশের ১০০ দিনের একটি কর্মসূচি অংশ নিয়ে ১৫০০ টাকা আয় করেন। এই টাকা দিয়েই তিনি তার ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম বার তিনি শুধু লেবুর স্কোয়াশ বানিয়েছিলেন। পণ্য তৈরির চেয়ে বিক্রি করা আরও কঠিন। এটাই ভাবছিলেন তিনি। স্থানীয় এক বাচ্চাদের অনুষ্ঠানে তিনি তার খাবার গুলি সকলকে টেস্ট করান। ইতিবাচক ভাবেই সকলে তার খাবার গুলি খুব পছন্দ করে। তার পর থেকেই তিনি ঘরে আরও নানা ধরনের আচার, সস বানানো শুরু করেন। তার কাছে অনেক অর্ডারও আসতে থাকে। ধীরে ধীরে তার খাবার গুলির চাহিদা বাড়তে থাকে। আজ তার ব্যবসায় ৬০ থেকে ৭০ ধরনের আচার, সস, জ্যাম ইত্যাদি বানানো হয়।
তার ছেলে কিংশুক সংবাদদাতাদের জানিয়েছেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখেছেন,সে ও তার বোন যেন সুন্দর ভবিষ্যত পায়, তাদের যেন খাবারের অভাব না হয় এই জন্য তার বাবা মা দিন রাত লড়াই করেছেন। তখন থেকেই তিনি তার বাবা মায়ের এই লড়াইতে পাশে ছিলেন।
লাভিনার ব্যবসার ১৫ বছর হয়ে গেছে। যেই ব্যবসার লড়াইটাও কঠিন ছিল। একসময় দরজায় দরজায় ঘুরে তারা তাদের খাবারের প্রচার করত। কিন্তু বার বার ফিরে আসত। কিভাবে মানুষের কাছে এর প্রচার করবেন এই উপায় তাকে তার স্বামী দেন। আজ দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার তৈরি আচারের বিরাট চাহিদা রয়েছে। এখন তিনি মাসে ৩০০ টিরও বেশি অর্ডার পান। লাভিনা জানান, এই রান্না তাদের জীবন যুদ্ধের প্রতীক, ক্যান্সারকে হারানোর প্রতীক। তিনি সকলকে বলে থাকেন, জীবনে যতই বাধা আসুক, শেষ অবধি লড়াই করে যেতে হবে। জীবন এক যুদ্ধের মতই, এখানে হেরে গেলে চলবে না। লাভিনা যখন এ কথা বলছিলেন, তাঁর চোখে জল। যাঁরা শুনছিলেন, তাঁদেরও।
প্রতিবেদক : শিউলি ভট্টাচার্য্য