আমুদরিয়া নিউজ : শরীরের এক ফোটা রক্ত সকল ভেদাভেদের উপরে। রক্ত কোনও জাতি, ধর্ম, গায়ের রঙ, লিঙ্গ দেখে না। শরীরের কোনও রোগ, বা দুর্ঘটনার কারণে জীবন যখন ঝুঁকির মুখে পড়ে তখন রক্ত দিতে বা নিতে গেলে সব ভেদাভেদ দুর হয়ে যায়। তখন জীবনের আসল লক্ষ্য হয়ে ওঠে অপর জনকে বাঁচিয়ে তোলা। এমনই এক লক্ষ্য পূরণে ১০০ তম রক্তদানের গণ্ডি পার করলেন গোয়ার এক ব্যক্তি। আসুন জেনে নিন তাঁর এই মহান কাজের দীর্ঘ যাত্রার কাহিনীটি,
গত ২০২৪ এর ১৪ অক্টোবর গোয়ার মারিও ফার্নান্দেস ৫০ বছর পূর্ণ করলেন। একই দিনে তিনি আরও একটি মাইলফলক অর্জন করেন, তাঁর ১০০ তম রক্তদান। তিনি ১৮ বছর বয়স থেকেই রক্তদান করে আসছেন। তাঁর লক্ষ্য ৬৫ বছর বয়স অবধি সুস্থ থাকলে তিনি এমন ভাবেই রক্তদান করে যাবেন।
মারিও গোয়া ব্লাড ডোনেশন অ্যাসোসিয়েশন পরিচালনা করেন। তাঁর মতে রক্তদান হল কারোর জীবন বাঁচানোর সবচেয়ে সহজ উপায়। তাঁর এই সংস্থাটি বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংকে, হাসপাতা্লে,দ্রুত রক্তের প্রয়োজন এমন ব্যক্তিদের এবং রক্তে হিমোগ্লোবিন কম রয়েছে এমন মানুষদের জরুরি অবস্থায় রক্ত সরবরাহ করে।
রক্তদানের বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তর জানতে চাইলে তিনি জানান, তিনি রক্তদান করেন কারণ, এখন কম লোকই এই কাজ করতে ইচ্ছুক। রক্তের গ্রুপ মিলিয়ে যে কাউকে প্লেটলেট দেওয়া যেতে পারে এবং একজন ব্যক্তি প্রতি ১৫ দিন অন্তর রক্তদান করতে পারেন। তিনি আরও বলেন যে একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতি তিন মাসে একবার সম্পূর্ণ রক্তদান করতে পারেন। অনেকেই প্লেটলেট দান করতে চান না কারণ এই প্রক্রিয়াটিতে প্রায় দুই ঘন্টা সময় লাগে। এই সময় রক্তদাতার রক্ত একটি বিশেষ মেশিনে প্রবাহিত হয় যা প্লেটলেটগুলিকে অন্যান্য উপাদান থেকে আলাদা করে, যা পরে রক্ত দাতার শরীরে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি জানান, রক্তদানের পরে, তিনি তরল জাতীয় খাবার যেমন ফলের রস, স্যুপ খান যাতে শরীরে তরল পদার্থের ঘাটতি পুনরায় পূরণ হয়।
মারিও বলেন যে রক্তদানের প্রতি তার আগ্রহই তাকে সুস্থ, শক্তিশালী ও প্রাণবন্ত করে রেখেছে। তিনি মদ্যপান বা ধূমপান করেন না এবং তার শরীরে আয়রন এবং হিমোগ্লোবিনের মাত্রা উচ্চ রাখার জন্য শাকসবজি, বাদাম, বীজ, ডিম এবং চর্বিহীন মাংস খান। তিনি সংবাদদাতাদের জানান, কাউকে জীবন উপহার দেওয়া, মদ্যপান বা ধূমপানের মতো অস্বাস্থ্যকর জিনিস সেবনের চেয়ে অনেক বেশি আনন্দের। এ ছাড়াও জীবনকে উপভোগ করার জন্য গান শোনা, নাচ, স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া, ঘুরতে যাওয়া প্রভৃতিও করেন তিনি।
মারিওর শৈশব কেটেছে মুম্বইতে। তিনি টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের পাশেই থাকতেন। তাঁদের বাড়িতে তাঁরা প্রায়শই দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার প্রয়োজন এমন ক্যান্সার রোগীদের থাকার ব্যবস্থা করতেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মা তাঁকে এবং তাঁর বড় ভাই নেলসনকে মানুষকে সাহায্য করতে শিখিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, যদি আমরা কারও জীবনে কোনও পরিবর্তন আনতে পারি, তা হলে তারা সেভাবেই অপর জনকে সাহায্য করে এই চেনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তিনি কোভিড-১৯ লকডাউনের সময়, যারা বাড়ি থেকে বের হতে পারতেন না তাদের কাছে ওষুধ এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দিতেন, বয়স্কদের হাসপাতালে নিয়ে যেতেন এবং প্রয়োজনে হাসপাতালের বিছানা এবং অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করতে সাহায্য করতেন।
মারিও বলেন সবাই যদি নিয়মিত রক্তদানের চেষ্টা করে, বিশেষ করে যাদের রক্তের গ্রুপ বিরল, তা হলে হাজার হাজার রোগীর জীবন বাঁচবে। দুর্ঘটনার শিকার, ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশু, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং অন্যান্য কারণে গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রয়োজনে সকলের উচিত রক্তদান করা। তাঁর মতে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হল রক্তের গ্রুপ মিলে গেলেও অনেকে তাদের আত্মীয়দের রক্তদান করতে অস্বীকার করে, যা কখনই করা উচিত না।
রক্ত জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে। এমনকি যারা ভিন্ন অন্যদের সাথে মেলামেশা এড়িয়ে চলেন তারাও রক্ত নেওয়ার প্রয়োজনে এই বিভেদগুলোকে একপাশে রাখতে পারেন। আজ মারিও হাজার হাজার মানুষকে এই অনুপ্রেরণা দিয়ে চলেছেন। তিনি বহু মানুষের জীবনদানের আসল নায়ক। মারিওর মতো এমন মহান ব্যক্তির খুব প্রয়োজন এই সমাজে, এমনই মনে করেন অনেকে।
প্রতিবেদক : শিউলি ভট্টাচার্য্য