আমুদরিয়া নিউজ : ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয় যে, মনোবল আর দক্ষতার সামনে শারীরিক অক্ষমতাও হার মানতে বাধ্য। আজ আমরা দেশের এক রত্নের কথা জানব, যিনি দৃষ্টিহীন হয়েও যাঁরা চোখে দেখতে পারেন, তাঁদের সাথে লড়াই করে দেশের জন্য স্বর্ণপদক জিতেছেন।
আসলে বহু বিখ্যাত খেলোয়াড়দের পরিচিতির ভিড়ে হারিয়ে যায় এই প্রতিভাবানদের কথা। আমরা এক সংবাদমাধ্যমেই এই প্রতিভাবানের কাহিনীটি জানতে পেরেছি। তাই আমরা আপনাদের সামনেও ওঁর জীবনের কিছু কথা তুলে ধরব।
দর্পণ ইনানি, তিন বছর বয়সে তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার বাবা-মায়ের সমর্থন ও নিজের দৃঢ় মনোবল এর কারণে ৩০ বছর বয়সী এই খেলোয়াড় ২০২৩ সালের অক্টোবরে চিনে অনুষ্ঠিত প্যারা এশিয়ান গেমসে দুটি স্বর্ণপদক জিতেছেন। ২০১৮ সালের ফ্রান্সের ক্রিয়ন ওপেন ইন্টারন্যাশনাল দাবা টুর্নামেন্টে তিনি দৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন খেলোয়াড়দের হারিয়েছিলেন। তিনি ভারতের একমাত্র এবং প্রথম প্রতিবন্ধী যিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ টুর্নামেন্টে শীর্ষস্থান অর্জন করেন। তার জীবনের বেশিরভাগ খেলাই দৃষ্টিশক্তি সম্পন্নদের বিরুদ্ধেই হয়েছিল।
বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে দর্পণ, রাজস্থানের উদয়পুরে জন্মগ্রহণ করেন। যখন তার বয়স ছয় মাস, তার পরিবার গুজরাটে চলে যায়। সেখানে তার বাবা নিজের ব্যবসা শুরু করতে চেয়েছিলেন। তখন থেকেই তারা ভদোদরায় থাকতেন। মাত্র তিন বছর বয়সেই তিনি স্টিভেন্স জনসন সিনড্রোমে আক্রান্ত হন। যা একটি বিরল রোগ এবং এর প্রভাবে তিনি দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেন। মাত্র ৮ বছর বয়সে তার পঞ্চাশটি অপারেশন হয়েছিল। তাতেও কোন সুরাহা হয়নি।
ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিলে ও তার বাবা মা চেষ্টা চালিয়ে যান। তারা সিদ্ধান্ত নেন তার পড়াশোনা কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু বহু স্কুলে তাকে ভর্তি নেওয়া হয়নি। তবুও তার বাবা চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ততদিন অবধি তাকে বাড়িতেই পড়াশোনা করতে হয়েছিল।
স্কুলের কথা জিজ্ঞাসা করতেই দর্পণ সংবাদদাতা কে জানান, বরোদা হাই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে অবশেষে তিনি ভর্তি হন। স্কুলে ভর্তির পর তার জীবনটা একদম অন্যরকম ছিল। স্কুলের একমাত্র অন্ধ ছাত্র ছিলেন তিনি। কিন্তু তার শিক্ষক ও তার বন্ধুরা, ভীষণ সহায়ক ছিল। তারা তাকে ঘুরে বেড়াতে ও পড়া বুঝতে সাহায্য করত।
একজন অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি, তাই কখনো তার টিউশনের প্রয়োজন পড়েনি। প্রতিবার সে ক্লাসে প্রথম হত নয়তো দ্বিতীয়।
অন্ধ হওয়ার জন্য নয়, তার অনুপ্রেরণামূলক শেখার পদ্ধতির জন্যই সবার থেকে আলাদা ছিলেন তিনি। সুবিধা নিয়ে পড়াশোনা করা বা পরীক্ষা দিতেন না। স্কুল থেকে একটি প্রশ্নপত্র তাকে স্ক্যান করে দেওয়া হত এবং তিনি জস নামক একটি কথা বলা যন্ত্রের সাহায্যে প্রশ্ন শুনে উত্তর দিতেন। জস হলো এটি কম্পিউটার স্ক্রিন রিডার যা অন্ধ এবং প্রতিবন্ধীদের লেখা পড়ে শোনায়।
কখন থেকে তিনি দাবার প্রতি আকৃষ্ট হন ?
প্রশ্নটি করতেই দর্পণ জানান, তিনি, খো খো, কাবাডির মতো শারীরিক খেলাধুলা খেলতে পারতেন না, তাই তার বাবা তাকে ভদোদরার ব্লাইন্ড ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ভর্তি করান যেখানে তিনি দৃষ্টিহীনদের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা একটি দাবার বোর্ড তৈরি করেন। তিনি দাবার প্রতি ভীষণ মনোযোগ দিয়েছিলেন, কারণ, এটাই একমাত্র খেলা ছিল যেখানে দৃষ্টিহীনরা দৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন খেলোয়াড়দের সাথে লড়তে পারেন এবং কোন নিয়ম ছাড়াই তাদের হারাতে পারেন।
দর্পণের বাবা সতীশ ইনানি, তাকে দাবার বিষয়গুলো শিখিয়েছিলেন। তিনি জানান, ব্লাইন্ড অ্যাসোসিয়েশন থেকে দর্পণকে এক প্যাকেট তাস, একটি বল ও একটি দাবার বোর্ড দেওয়া হয়েছিল। তারা চাইনি যে দর্পণ তাস খেলুক তাই তারা দাবা খেলার ওপরে গুরুত্ব দিয়েছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি দাবা খেলাতেও পারদর্শী হয়ে উঠেছিল দর্পণ। তিনি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট এর পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করেছিলেন। ২০১৫ তে তিনি ক্যাট পরীক্ষা দেন এবং আইআইএম লখনৌ তে ভর্তি হন। পড়াশোনায় খুব ব্যস্ত থাকায় তিনি দাবা খেলতে পারতেন না।
তারপর তিনি পড়াশোনা শেষ করে আবার দাবার অনুশীলন শুরু করেন। ২০২৩ সালে প্যারা এশিয়ান গেমসে তিনি দেশের জন্য দুটি স্বর্ণপদক জিতেছেন, এটা তার ও তার বাবা মায়ের জন্য ভীষণ গর্বের ছিল। তারা জানান, তারা যদি তাদের ছেলের কারণে পরিচিত হয় তাহলে সেটা তাদের জন্য সবচেয়ে বড় আনন্দের বিষয়। দর্পণের কোচ শ্রীনাথ নারায়ণ জানান, দর্পণের চমৎকার যুক্তিসঙ্গত চিন্তা রয়েছে যা দাবাতে ভীষণ উপকারী।
দর্পণ দুজন অসাধারণ ব্যক্তির কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেতেন, দাবার বিশ্বনাথন আনন্দ এবং প্রয়াত পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং।
২০১০ সালে দর্পণ প্রথম বিশ্বনাথ আনন্দের সাথে দেখা করেন, যখন তার বয়স ছিল ১৬ বছর তিনি জাতীয় অন্ধ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। সেখান থেকেই তার সাফল্যে যাত্রা শুরু হয়। রাজ্যের ও দেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় জিতেছেন তিনি।
প্রতিভার ঝুলি দর্পণ। পড়াশোনায় যেমন পারদর্শী, দাবায় যেমন দক্ষ, তেমনি সংগীতেও সে ভীষণ প্রতিভাবান। চার বছর ধরে তিনি হারমোনিয়াম এবং তবলা শিখেছেন। দাবা খেলার জন্য তিনি গান শেখা বন্ধ করেছিলেন কিন্তু তবুও তিনি গান খুব পছন্দ করেন। বর্তমানে তিনি সিএ হিসেবে কর্মরত। তিনি সকলকে শিখিয়েছেন জীবন এবং দাবা বা যে কোন খেলাই দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে, দৃষ্টিশক্তির উপর নয়। সহজ কথায়, আপনার জীবন এবং আপনার কাজ আপনি কি দেখেন তা নয় বরং আপনি কি চিন্তা করেন এবং কতটা সাহসের সাথে লড়াই করেন তার ওপরেই নির্ভর করে।
প্রতিবেদক : শিউলি ভট্টাচার্য্য